ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়ক সৌরভ
গাঙ্গুলী মানুষ হিসেবেও যে কতটা মহানুভব, তার প্রমাণ দিলেন। সম্প্রতি
ক্রিকেট মাঠে আঘাত পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন বাংলা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটার
অঙ্কিত কেশরি। ক্রিকেট বোর্ড থেকে প্রাপ্ত পেনশনের টাকা তিনি তুলে দিয়েছেন
অঙ্কিত কেশরির পরিবারের হাতে। সৌরভ টেস্ট ক্রিকেটে ১৬টি সেঞ্চুরিসহ ৭,২১২
রান এবং ওয়ান ডে ক্রিকেটে ২২টি সেঞ্চুরিসহ করেছেন ১১,৩৬৩ রান।
নেতৃত্ব শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। আমার নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে। যখন আমি প্রথম ভারতীয় দলে খেলতে এলাম, তখন প্রায়ই অধিনায়ক বদল হতো। বিদেশের মাটিতে খেলার সময় দলগতভাবে আমাদের অনেকটা দুর্বল ভাবত সবাই। হয়তো টেন্ডুলকার সেঞ্চুরি করবেন বা আজহারউদ্দিন। তার পরও দেখা যাবে কোনো না কোনোভাবে ভারত ম্যাচ হেরে গেছে। হয়তো দু-একটা টেস্টে ড্র করতে পারবে, তার বেশি নয়। সেই সময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল একজন নেতার, যিনি দলের সদস্যদের চিন্তার ধরনটাই বদলে দিতে পারবেন।
আমার কাছে নেতৃত্ব মানে দলের সবার মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি করা। তোমরা আগামী দিনে বড় বড় করপোরেশনের সিইও হবে, হয়তো রাজনীতিবিদ হবে বা অনেক বড় কিছু করবে। কিন্তু জীবনের যে ক্ষেত্রেই বলো না কেন, একজন ভালো নেতা হতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আস্থা। যাদের নিয়ে কাজ করবে, যাদের দিয়ে কাজ করাবে, তারা সবাই যাতে তোমার ওপর নির্দ্বিধায় আস্থা রাখতে পারে। তুমি মুখে অনেক কিছু বলতে পারো, অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজের সময় অন্য কিছু করার চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু মনে রাখবে, এভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে পারে, কিন্তু সারা জীবন এভাবে তুমি কাউকে ভুলিয়ে রাখতে পারবে না। দিনের শেষে সবাই ঠিকই বুঝে যাবে, কী ঘটছে। মানুষকে বেশি দিন বোকা বানানো যায় না।
আজকের তরুণেরা আমার প্রজন্মের তরুণদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। আমি যখন আমার মেয়ে সানা কিংবা আমার বন্ধুদের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে ভাবি, এই বয়সে আমি কী ছিলাম, তখন বুঝতে পারি এখনকার ছেলেমেয়েরা কত পরিণত, তাদের চিন্তাভাবনা কত ভিন্ন! তাই যারাই আগামী দিনের প্রজন্মকে নেতৃত্ব দেওয়ার চিন্তা করছ, তোমাদের খেয়াল রাখতে হবে, কীভাবে নিজেদের দল গঠন করবে এবং দলের সবার মধ্যে তোমার প্রতি আস্থা তৈরি করবে। যখন তোমাদের কর্মীদের নিয়ে, ম্যানেজারদের নিয়ে বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে বসবে, সবাই যাতে তোমার ওপর ভরসা রাখতে পারে। সবাই যেন বিশ্বাস করতে পারে যে দিনের শেষে তুমি তাদের হতাশ করবে না। তাদের সামনে তুমি যা বলছ, তাদের চোখের আড়ালে গিয়েও তুমি ঠিক সেই কথাই বলবে বা সেই কাজটিই করবে। এর যেন কখনো কোনো ব্যতিক্রম না হয়।
আমি যখন ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করি, তখন আমি ঠিক এই কাজটিই করতে চেয়েছিলাম। যে ১৫ জন খেলোয়াড় ড্রেসিংরুমে থাকে, খেলার মাঠে তাদের সর্বোচ্চ প্রতিভাটুকু বের করে আনতে হলে তাদের মধ্যে অধিনায়কের প্রতি গভীর আস্থা থাকা প্রয়োজন। আমি চেয়েছিলাম, আমি যদি বীরেন্দর শেবাগ বা হরভজন সিংকে বলি কোনো একটি কাজ করতে হবে, তারা যেন চোখ বন্ধ করে আমার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে সে কাজটি করে। দলের প্রত্যেক সদস্য যাতে বিশ্বাস করে যে অধিনায়ক তাদের সামনে যা বলছেন, যখন তিনি সিলেকশন কমিটির সঙ্গে বসবেন, তখন তিনি ঠিক একই কথাই বলবেন। স্থানভেদে তাঁর মতামত বদলাবেন না। হ্যাঁ, কখনো কখনো এটা করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অফিসের বস বা দলের অধিনায়কের কাছ থেকে কেউ যখন শোনে যে তার পারফরম্যান্স ভালো হচ্ছে না বা তাকে পরের খেলায় দলে রাখা হবে না, সেটা মেনে নেওয়া সহজ নয়। কিন্তু একজন অধিনায়ক হিসেবে কঠিন হলেও এই স্বচ্ছতাটুকু বজায় রাখতে হবে, এভাবেই একটি দারুণ দল গড়ে তোলা সম্ভব।
২০০০ সালে আমি যখন প্রথম অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন আমার দলকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হয়েছিল। দলের জন্য সময়টা ভালো যাচ্ছিল না, বাতাসে অনেক গুজব ভাসছিল। সে অবস্থা থেকে আমার দলকে টেনে তুলতে হয়েছে। দেখা যেত আমার বেশির ভাগ সময় চলে যাচ্ছে খেলোয়াড় আর কোচের মধ্যে ঝামেলা মেটাতে আর দলের সবার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে। এমনকি তাদের ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক সংকটের সময়েও আমাকে গিয়ে পাশে দাঁড়াতে হয়েছে। এসব কিছু করার অবসরে আমি প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেতাম। যত যা-ই হোক, খেলায় রান তো করতে হবে!
আমার অভিজ্ঞতা বলে, নির্দিষ্ট একটি কাজ করার মধ্যে নেতৃত্ব কখনো সীমাবদ্ধ থাকে না। নেতৃত্ব দিতে হলে একসঙ্গে অনেক কিছু সামাল দিতে হয়, অনেক ভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। একজন নেতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব হলো, প্রয়োজনের সময় তার দলের সদস্যদের, কিংবা কর্মীদের, পাশে এসে দাঁড়ানো। আমি একটি ব্যাপার খুব গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে আমরা সবাই যার যার কাজে ভালো করতে চাই। সে আমাদের মতো খেলোয়াড়েরাই হোক বা তোমাদের মতো শিক্ষার্থীরাই হোক, সবাই চায় সফল হতে, দারুণ কিছু করে দেখাতে। একজন নেতাকে অবশ্যই তার দলের সদস্যদের এই আকাঙ্ক্ষাটুকু বুঝতে হবে এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে হবে।
একই সঙ্গে দলের সবাইকে এটিও বোঝাতে হবে যে কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। কেউ কফিশপে বসে বসে চিকিৎসক হতে পারবে না, কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে কেউ এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করতে পারবে না। যার যে উদ্দেশ্য, তা অর্জনের জন্য তাকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। তুমি যা করবে, ঠিক তারই ফল পাবে।
নেতৃত্ব নিয়ে অনেকে তোমাদের অনেক আইডিয়া দেবে, এ ব্যাপারে তত্ত্ব ও তথে্যর কোনো অভাব নেই। কিন্তু আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি একটি কথাই বলতে পারি যে নেতা হলে চাইলে তোমাকে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রয়োজনের সময়, বিপদের দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখবে, মানুষের সুখের দিনে সারা পৃথিবী তাকে ঘিরে থাকে, কিন্তু দুঃখের দিনে কেউ থাকে না। সেই সময় নেতাকেই এসে তাদের পাশে দাঁড়াতে হয়, তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। একই সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে তুমি যত সহানুভূতিশীল, সহৃদয় হও না কেন, নিজের উদ্দেশ্যের কথা ভুলে গেলে চলবে না। সবাইকে সাহায্য করার পাশাপাশি অধিনায়ক হিসেবে বা দলনেতা হিসেবে তোমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তা ঠিকভাবে পালন করতে হবে।
তোমরা যারা আগামী দিনের নেতা, তাদের জন্য আমার তিনটি উপদেশ থাকবে। প্রথমত, অকারণে কোনো কিছুকে জটিল করে তুলো না। জীবনকে সহজ ও সুন্দর রাখো এবং নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করে যাও। দ্বিতীয়ত, কঠোর পরিশ্রম করো। তুমি যে পেশাতেই নিয়োজিত হও না কেন, তার শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য পরিশ্রম করে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা সবাই আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে অফিস পলিটিকস, স্বজনপ্রীতির কথা বলি। কিন্তু পেছনে যা-ই চলতে থাকুক না কেন, তুমি যদি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাও, কেউ তোমাকে থামিয়ে রাখতে পারবে না। তৃতীয়ত, নিজের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।
এখানে আসার আগে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমার অনুপ্রেরণা কী? এত কিছু পেরিয়ে আমি কীভাবে দলে ফিরে এসেছিলাম এবং ভালো পারফরম্যান্সও করতে পেরেছিলাম? আমার বয়স এখন ৪০ পেরিয়েছে, খেলা ছেড়েছি কয়েক বছর হয়ে গেল। কিন্তু বিশ্বাস করো, যখন আমি প্রতিদিন অফিসে যাই, আমার সহকর্মীদের সঙ্গে প্রথম কথা হয় ক্রিকেট নিয়ে, অফিসের কাজ নিয়ে নয়। আমি তাদের বলি, আমাকে শুধু দুই মাস ট্রেনিংয়ের সময় দাও, আমি এখনো ভারতের জন্য রান করতে পারব। এই দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও মনোবলই আমাকে এতটা সময় ধরে মাঠে টিকিয়ে রেখেছিল। যতবার আমি মাঠে পা রেখেছি, এই বিশ্বাস নিয়েই রেখেছি যে আজ আমি সফল হব, আমি নিশ্চয়ই পারব। আমার যদি এতটুকুও সংশয় থাকত যে আজ আমি হয়তো পারব না, হয়তো পোলক কিংবা এন্ডারসনের বলে আজ আমি আউট হয়ে যাব, তাহলেই আমি আর কখনো সফল হতে পারতাম না। আর এসব কিছু করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি যদি তোমার চারপাশের মানুষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করতে পারো, তাদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে পারো, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তুমি একজন যোগ্য নেতা হয়ে গড়ে উঠবে।
সূত্র: ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট কলকাতার বার্ষিক ব্যবসায় সম্মেলন ২০১৩–তে দেওয়া বক্তৃতা। ইংরেজি থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার।
নেতৃত্ব শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। আমার নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে। যখন আমি প্রথম ভারতীয় দলে খেলতে এলাম, তখন প্রায়ই অধিনায়ক বদল হতো। বিদেশের মাটিতে খেলার সময় দলগতভাবে আমাদের অনেকটা দুর্বল ভাবত সবাই। হয়তো টেন্ডুলকার সেঞ্চুরি করবেন বা আজহারউদ্দিন। তার পরও দেখা যাবে কোনো না কোনোভাবে ভারত ম্যাচ হেরে গেছে। হয়তো দু-একটা টেস্টে ড্র করতে পারবে, তার বেশি নয়। সেই সময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল একজন নেতার, যিনি দলের সদস্যদের চিন্তার ধরনটাই বদলে দিতে পারবেন।
আমার কাছে নেতৃত্ব মানে দলের সবার মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি করা। তোমরা আগামী দিনে বড় বড় করপোরেশনের সিইও হবে, হয়তো রাজনীতিবিদ হবে বা অনেক বড় কিছু করবে। কিন্তু জীবনের যে ক্ষেত্রেই বলো না কেন, একজন ভালো নেতা হতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আস্থা। যাদের নিয়ে কাজ করবে, যাদের দিয়ে কাজ করাবে, তারা সবাই যাতে তোমার ওপর নির্দ্বিধায় আস্থা রাখতে পারে। তুমি মুখে অনেক কিছু বলতে পারো, অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজের সময় অন্য কিছু করার চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু মনে রাখবে, এভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে পারে, কিন্তু সারা জীবন এভাবে তুমি কাউকে ভুলিয়ে রাখতে পারবে না। দিনের শেষে সবাই ঠিকই বুঝে যাবে, কী ঘটছে। মানুষকে বেশি দিন বোকা বানানো যায় না।
আজকের তরুণেরা আমার প্রজন্মের তরুণদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। আমি যখন আমার মেয়ে সানা কিংবা আমার বন্ধুদের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে ভাবি, এই বয়সে আমি কী ছিলাম, তখন বুঝতে পারি এখনকার ছেলেমেয়েরা কত পরিণত, তাদের চিন্তাভাবনা কত ভিন্ন! তাই যারাই আগামী দিনের প্রজন্মকে নেতৃত্ব দেওয়ার চিন্তা করছ, তোমাদের খেয়াল রাখতে হবে, কীভাবে নিজেদের দল গঠন করবে এবং দলের সবার মধ্যে তোমার প্রতি আস্থা তৈরি করবে। যখন তোমাদের কর্মীদের নিয়ে, ম্যানেজারদের নিয়ে বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে বসবে, সবাই যাতে তোমার ওপর ভরসা রাখতে পারে। সবাই যেন বিশ্বাস করতে পারে যে দিনের শেষে তুমি তাদের হতাশ করবে না। তাদের সামনে তুমি যা বলছ, তাদের চোখের আড়ালে গিয়েও তুমি ঠিক সেই কথাই বলবে বা সেই কাজটিই করবে। এর যেন কখনো কোনো ব্যতিক্রম না হয়।
আমি যখন ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করি, তখন আমি ঠিক এই কাজটিই করতে চেয়েছিলাম। যে ১৫ জন খেলোয়াড় ড্রেসিংরুমে থাকে, খেলার মাঠে তাদের সর্বোচ্চ প্রতিভাটুকু বের করে আনতে হলে তাদের মধ্যে অধিনায়কের প্রতি গভীর আস্থা থাকা প্রয়োজন। আমি চেয়েছিলাম, আমি যদি বীরেন্দর শেবাগ বা হরভজন সিংকে বলি কোনো একটি কাজ করতে হবে, তারা যেন চোখ বন্ধ করে আমার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে সে কাজটি করে। দলের প্রত্যেক সদস্য যাতে বিশ্বাস করে যে অধিনায়ক তাদের সামনে যা বলছেন, যখন তিনি সিলেকশন কমিটির সঙ্গে বসবেন, তখন তিনি ঠিক একই কথাই বলবেন। স্থানভেদে তাঁর মতামত বদলাবেন না। হ্যাঁ, কখনো কখনো এটা করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অফিসের বস বা দলের অধিনায়কের কাছ থেকে কেউ যখন শোনে যে তার পারফরম্যান্স ভালো হচ্ছে না বা তাকে পরের খেলায় দলে রাখা হবে না, সেটা মেনে নেওয়া সহজ নয়। কিন্তু একজন অধিনায়ক হিসেবে কঠিন হলেও এই স্বচ্ছতাটুকু বজায় রাখতে হবে, এভাবেই একটি দারুণ দল গড়ে তোলা সম্ভব।
২০০০ সালে আমি যখন প্রথম অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন আমার দলকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হয়েছিল। দলের জন্য সময়টা ভালো যাচ্ছিল না, বাতাসে অনেক গুজব ভাসছিল। সে অবস্থা থেকে আমার দলকে টেনে তুলতে হয়েছে। দেখা যেত আমার বেশির ভাগ সময় চলে যাচ্ছে খেলোয়াড় আর কোচের মধ্যে ঝামেলা মেটাতে আর দলের সবার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে। এমনকি তাদের ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক সংকটের সময়েও আমাকে গিয়ে পাশে দাঁড়াতে হয়েছে। এসব কিছু করার অবসরে আমি প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেতাম। যত যা-ই হোক, খেলায় রান তো করতে হবে!
আমার অভিজ্ঞতা বলে, নির্দিষ্ট একটি কাজ করার মধ্যে নেতৃত্ব কখনো সীমাবদ্ধ থাকে না। নেতৃত্ব দিতে হলে একসঙ্গে অনেক কিছু সামাল দিতে হয়, অনেক ভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। একজন নেতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব হলো, প্রয়োজনের সময় তার দলের সদস্যদের, কিংবা কর্মীদের, পাশে এসে দাঁড়ানো। আমি একটি ব্যাপার খুব গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে আমরা সবাই যার যার কাজে ভালো করতে চাই। সে আমাদের মতো খেলোয়াড়েরাই হোক বা তোমাদের মতো শিক্ষার্থীরাই হোক, সবাই চায় সফল হতে, দারুণ কিছু করে দেখাতে। একজন নেতাকে অবশ্যই তার দলের সদস্যদের এই আকাঙ্ক্ষাটুকু বুঝতে হবে এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে হবে।
একই সঙ্গে দলের সবাইকে এটিও বোঝাতে হবে যে কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। কেউ কফিশপে বসে বসে চিকিৎসক হতে পারবে না, কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে কেউ এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করতে পারবে না। যার যে উদ্দেশ্য, তা অর্জনের জন্য তাকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। তুমি যা করবে, ঠিক তারই ফল পাবে।
নেতৃত্ব নিয়ে অনেকে তোমাদের অনেক আইডিয়া দেবে, এ ব্যাপারে তত্ত্ব ও তথে্যর কোনো অভাব নেই। কিন্তু আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি একটি কথাই বলতে পারি যে নেতা হলে চাইলে তোমাকে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রয়োজনের সময়, বিপদের দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখবে, মানুষের সুখের দিনে সারা পৃথিবী তাকে ঘিরে থাকে, কিন্তু দুঃখের দিনে কেউ থাকে না। সেই সময় নেতাকেই এসে তাদের পাশে দাঁড়াতে হয়, তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। একই সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে তুমি যত সহানুভূতিশীল, সহৃদয় হও না কেন, নিজের উদ্দেশ্যের কথা ভুলে গেলে চলবে না। সবাইকে সাহায্য করার পাশাপাশি অধিনায়ক হিসেবে বা দলনেতা হিসেবে তোমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তা ঠিকভাবে পালন করতে হবে।
তোমরা যারা আগামী দিনের নেতা, তাদের জন্য আমার তিনটি উপদেশ থাকবে। প্রথমত, অকারণে কোনো কিছুকে জটিল করে তুলো না। জীবনকে সহজ ও সুন্দর রাখো এবং নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করে যাও। দ্বিতীয়ত, কঠোর পরিশ্রম করো। তুমি যে পেশাতেই নিয়োজিত হও না কেন, তার শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য পরিশ্রম করে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা সবাই আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে অফিস পলিটিকস, স্বজনপ্রীতির কথা বলি। কিন্তু পেছনে যা-ই চলতে থাকুক না কেন, তুমি যদি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাও, কেউ তোমাকে থামিয়ে রাখতে পারবে না। তৃতীয়ত, নিজের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।
এখানে আসার আগে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমার অনুপ্রেরণা কী? এত কিছু পেরিয়ে আমি কীভাবে দলে ফিরে এসেছিলাম এবং ভালো পারফরম্যান্সও করতে পেরেছিলাম? আমার বয়স এখন ৪০ পেরিয়েছে, খেলা ছেড়েছি কয়েক বছর হয়ে গেল। কিন্তু বিশ্বাস করো, যখন আমি প্রতিদিন অফিসে যাই, আমার সহকর্মীদের সঙ্গে প্রথম কথা হয় ক্রিকেট নিয়ে, অফিসের কাজ নিয়ে নয়। আমি তাদের বলি, আমাকে শুধু দুই মাস ট্রেনিংয়ের সময় দাও, আমি এখনো ভারতের জন্য রান করতে পারব। এই দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও মনোবলই আমাকে এতটা সময় ধরে মাঠে টিকিয়ে রেখেছিল। যতবার আমি মাঠে পা রেখেছি, এই বিশ্বাস নিয়েই রেখেছি যে আজ আমি সফল হব, আমি নিশ্চয়ই পারব। আমার যদি এতটুকুও সংশয় থাকত যে আজ আমি হয়তো পারব না, হয়তো পোলক কিংবা এন্ডারসনের বলে আজ আমি আউট হয়ে যাব, তাহলেই আমি আর কখনো সফল হতে পারতাম না। আর এসব কিছু করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি যদি তোমার চারপাশের মানুষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করতে পারো, তাদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে পারো, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তুমি একজন যোগ্য নেতা হয়ে গড়ে উঠবে।
সূত্র: ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট কলকাতার বার্ষিক ব্যবসায় সম্মেলন ২০১৩–তে দেওয়া বক্তৃতা। ইংরেজি থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন